বাদশা মিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

তার নাম বাদশা মিয়া। বয়স সবে চৌদ্দ, মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পরে।পরিবারে খুব টানাটানি। সংসার চালাতে বাবাকে কিছুটা সহযোগিতা করতে দশ টাকা পকেটে নিয়ে মাদারীপুরের শিবচর থেকে লঞ্চে উঠে বসলেন। নারায়ণগঞ্জের কাঠপট্টি এলাকায় নেমে হেটে হেটে এলেন তান বাজারে,এলাকার এক পরিচিত বড় ভাইয়ের দোকানে উঠলেন।
রাশি রাশি সুতার মধ্যে দিলেন ঘুম,তান বাজারে সুতার কোনো টান নেই। এ জন্যই তো বেশ কিছুদিন পর রব ভূইয়া নামের এক দোখান থেকে এক বান্ডেল সুতা বাকিতে কিনে এনে বিক্রি করলেন এক ক্রেতার কাছে। কোনো পুঁজি ছারাই লাভ করলেন চার টাকা।পড়াশোনা তেমন একটা না জানলেও তান বাজারের হাব ভাব অল্পদিনেই বেশ ভালো বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। সুতো কেনা বেচায় সে সময়টায় দালালি প্রথা ছিলো। এক দোখানের সুতা অন্য দোখান বা ক্রেতার কাছে বিক্রি করে কমিশন মিলতো। এক বের সুতা অর্থাৎ চারশ আশি পাউন্ড বিক্রি করতে পারলে আয় হতো সাত টাকার মতো। এভাবে জীবনের শুরুর দিকটায় সুতার দালালি করে বেশ ভালো অর্থ উপার্জন করেন বাদশা মিয়া।
১৯৭৬ সালে পাইকারি সুতা বিক্রির লাইসেন্স করেন বাদশা মিয়া।তান বাজারে ভাড়ায় দোখান নেন এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে ভালো একটি জায়গায় সেটিকে স্থানান্তর ও করেন। তখন বাংলাদেশের বেশ কিছু বস্ত্রকল থেকে সরাসরি সুতা কিনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি শুরু করেন। সুতা বিক্রি করছেন বিভিন্ন হাটেও,সুতার ব্যবসা করে আশির দশকে কয়েক কোটিকোটি টাকার মালিক হয়ে যান বাদশা মিয়া।
১৯৮৫ সালের দিকে ভাইদের নিজের ব্যবসায় নিয়ে আসেন।এবার কিছুটা স্থির হলেন বাদশা মিয়া। পরের বছর ভারত থেকে তুলা আমদানি শুরু করেন। অবশ্য এর আগে সুতা আমদানিতে হাত পাকান তিনি। ধিরে ধিরে তান বাজারের বাদশা অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন বাদশা মিয়া। বিয়েও করলেন ওদিকে নারায়ণগঞ্জের চাষারায় নিজের বাড়িটাও করে ফেলেন। এর মধ্যে ছিলেন বেশ কিছু টেক্সটাইল মিলের এজেন্ট,আর এভাবেই কারখানা করার একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তার সূত্র ধরে ১৯৯৭ সালে ঢাকায় পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন। ১৯৯৯ সালে নারায়ণগঞ্জের পঞবটিতে ৪০০ মেশিন দিয়ে করলেন সুয়েটার কারখানা,যদিও বা দশ বছর পরে সেটিকে স্থানান্তর করেন ভালুকায়।
বর্তমানে কারখানায় মেশিনের সংখ্যা ২০০০। কাজ করেন ১৫০০০ হাজার শ্রমিক। পোষাক কারখানায় সফল হওয়ার পর বস্ত্রকল করার দিকে মনোযোগ দিলেন বাদশা মিয়া। ভালুকায় ১০০ বিঘা জমির উপরে বস্ত্রকল শুরু করেন ২০০৩ সালে। ধীরে ধীরে সেটি আবার বড় হতে থাকে।সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে ২৫০ বিঘা জমির উপরে দিনিং কাপর উৎপাদনের কারখানা করেন। সেখানে তার বিনিয়োগ ১২০০ কোটি টাকা।
তুলা থেকে সুতা উৎপাদনের প্রতটি স্তর আমার মুখস্থ। তবে আসল কারন টা বলেন অনেক পরে। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিলো শিল্প গড়বো সেখানে অনেক লোক কাজ করবেন। আমি আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। বাদশা মিয়ার সবচেয়ে ভালো দিকটা কি জানেন? তিনি কোনদিন অন্য আর পাঁচ দশটা ব্যবসায়ীর মতন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হননি। তিনিও আমদানি করে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকার লোকশানের মুখে পরলেও ব্যাংকের কাছে ঋণ খেলাপি হননি। বাদশা মিয়া জীবনের ষাট বছর বয়সে এসেও দিনে ১৬ ঘন্টার মতন কাজ করেন। রাতে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘন্টা ঘুমান। প্রায় মাঝরাতে ভালুকা বা হবিগঞ্জে চলে যান। তার সুতা ও ডেনিং কারখানায় দিন রাত ২৪ ঘন্টাই উৎপাদন হয়। পুরো কারখানা চক্কর দেন, নিজের চোখে উৎপাদন দেখেন তারপর ঘুমাতে যান। হাসতে হাসতে বাদশা মিয়া আরও বলেন আমি হলাম কামলা অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষ। কারখানায় কাজ করতে আমার বেশি ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে ২ দিনের জন্য হলেও ভালুকা বা হবিগঞ্জে যাইয়া থাকি।
তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে এই ব্যবসায়ীর পরামর্শ প্রথমে কাজ শিখতে হবে, তারপর সেই কাজের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে তাহলেই সফল হওয়া যাবে। সততা কঠোর পরিশ্রম ও পন্যের মানে আপোষ না করার কারনে আজকের পর্যায়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে করেন বাদশা মিয়া। নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে গত ৪৬ বছরে বস্ত্রখাতে শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একজন হয়েছেন। প্রতিষ্টা করেছেন বাদশা টেক্সটাইল কামাল ইয়ার পায়োনিয়ান নিটওয়্যার ও পায়োনিয়া ডিনিম নামে চারটি শিল্প প্রতিষ্টান।।